– পরেশ মণ্ডল
অনিন্দ্য রায়
‘শ্রুতি’ আন্দোলনের অন্যতম কবি পরেশ মণ্ডল ( জন্মঃ ৩রা মার্চ ১৯৪০ ), বাংলা কবিতায় একটি ব্যতিক্রমী নাম, এবং সাহসী, সন্ধানী ও নিরীক্ষামূলক । তাঁর কবিতার বিন্যাসে দৃশ্যগত অভিঘাতের খোঁজ করব আমরা এই লেখাটিতে । অবয়ব কবিতার ঐতিহ্যকে বুঝে নেওয়ার তাগিদে এই প্রচেষ্টা আমাদের ।
১৯৬৫ সালে ‘শ্রুতি’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় । পরেশ মণ্ডলের লেখালেখি শুরু তার আগেই ।১৯৬৩-তে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘ অদূরে জলের শব্দ’ বের হয়েছে । ‘… ৩৬টি কবিতার সংকলন । এর মধ্যে ১৪টি সনেট বা সনেটকল্প । … প্রথম গ্রন্থে পরেশ শুধুই অন্বেষক, নিজের স্বভাবকেই খুঁজছেন তিনি কিংবা এমন কোন প্রকরণ যা হাত ছানি দিয়ে চলে যায় কিন্তু ঠিক ধরা যায় না ।” ( উত্তম দাশ / কবিতায় পরেশ মণ্ডল / নির্বাচিত কবিতার ভূমিকা )
‘শ্রুতি’র প্রথম সংকলনেই কবিতা ছিল তাঁর ; ‘ প্রতিবিম্ব ও অন্যান্য কবিতা’, কবিতাগুলিঃ প্রতিবিম্ব, গোপনীয়, নিরাময়, তৃতীয় ভুবন, রহস্যময়, আশ্চর্য, সমীক্ষা, ধাঁধা । এই লেখাগুলি থকেই প্রকৃত পরেশ মণ্ডলকে চিনতে পারি আমারা ।
শব্দের ঊল্লম্ববিন্যাসে তিনি ‘প্রতিবিম্ব’ কবিতাটি লেখেন এবং যা পরবর্ত্তীতে তিনি অক্ষরসজ্জার অভিনবত্বের প্রয়াসী হয়ে উঠবেন তার ইঙ্গিত দেয় ।
(প্রতিবিম্ব / কাব্যগ্রন্থঃ প্রতিবিম্ব )
‘শ্রুতি’র ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম সংকলনগুলি সজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যুগ্ম সম্পাদনা করেছেন তিনি । দ্বিতীয় সংখ্যাতে আছে তাঁর গদ্য ‘ ভ্যালেরির কাব্যচিন্তা’ ।চতুর্থ সংকলনে স্প্যানিশ কবি হিমনেথ ও রাফাএল আলবার্তি, ইতালিয় কবি জুসেপ্পে উঙ্গারেত্তির কবিতা অনুবাদ করেন । ১৪টি সংকলনেই তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয় । একাদশ সংকলনে রমানাথ রায় আলোচনা করেন কবির ‘মানমন্দির’ কাব্যগ্রন্থ নিয়ে । এই আন্দোলনের কর্মকাণ্ডের মধ্যে ওতোপ্রোত অংশগ্রহণ ছিল তাঁর ।
পত্রিকার দ্বিতীয় সংকলনে পুষ্কর দাশগুপ্ত-র লেখা নীচের কথাগুলি
মুদ্রণের উন্নত অবস্থায় কবি সম্ভাব্য উপায়ে এবং প্রয়োজন অনুসারে কবিতার বিন্যাসে
দৃষ্টিগ্রাহ্য ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে পারেন । … বিশেষ কোনো ছক বা আকারে কবিতাকে
বিন্যস্ত করে কবি তার মানসিক অনুষঙ্গকে সাংকেতিক করতে পারেন।
পাঠকের পক্ষে এই ধরণের মুদ্রণ বিন্যাস দু’ভাবে কার্যকর হতে পারে । কবিতাপাঠের
সময় পাঠকের চোখ এবং কান মিশে যায় ; স্বভাবতই দৃষ্টিগ্রাহ্য বিন্যাসে পাঠক শুধু
চোখেই দেখেন না, কানেও সোনেন এবং তখন দৃষ্টিশ্রুতির যুক্তক্রিয়া কবিতা
উপলব্ধির সহায়ক হয় ।
আধুনিক কবিতার মুদ্রিতপ্রকাশে দৃষ্টিগ্রাহ্যতা সৃষ্টি বা নতুন বিন্যাসের ব্যাপারে মার্লামে
অ্যাপলিনার, মায়াকোভসকি, কমিংস, অমিয় চক্রবর্তী প্রভৃতি কৃতকর্মা কবির প্রয়াস
স্মরণীয় । এবং মুদ্রণবিন্যাসে দৃষ্টিগ্রাহ্যতা-সৃষ্টি বাংলা কবিতার চর্চার দ্বারা জীর্ণ হয়নি তা
প্রকরণ হিসেবে অকর্ষিত ভূমির মতোই সম্ভাবনাপূর্ণ ।
এবং তৃতীয় ইস্তেহারের
১. নতুন ধরণের মুদ্রণবিন্যাসের সাহায্যে কবিতার দৃষ্টিগ্রাহ্য ( Visual ) অনুষঙ্গ সৃষ্টি ।
২. ছেদচিহ্নের বিলোপ। প্রয়োজনীয় স্পেস ও বিশেষ পংক্তিবিন্যাসের মাধ্যমে কোথায় থেমে পড়তে হবে নির্দেশ । কবিতার ভাষায় মুখের কথায় স্বাভাবিক ব্যঞ্জনাসৃষ্টি।
এই কথাগুলি বাস্তবায়িত হতে দেখি পরেশ মণ্ডলের কবিতায় । তাঁর নিজের কথায়
“ গভীর ও গোপন এক অসন্তুষ্টি থেকে শ্রুতি-র জন্ম । মনে হয়, হাবার্ট রীড-এর distortion ও departure আমাদের সাহস ও উৎসাহ জুগিয়েছে । আপলিন্যের ও সুর-রেয়ালিজম্ আন্দোলন থেকে প্রেরণা পেয়েছি ।intellectual adventure কাজ করেছে হয়ত শ্রুতি-র প্রেক্ষাপটে । অংশত । … লুই আরাগঁ-র কথায় – কবিতার ইতিহাস তার আঙ্গিকের ইতিহাস । সেদিন বিশ্বাস করতাম, আজও করি ।”
(পরেশ মণ্ডল / শ্রুতিঃ কিছু স্মৃতি )
সেই বিশ্বাস থেকেই তাঁর নিজস্ব আঙ্গিক খুঁজে নেওয়া, তাঁর ।intellectual adventure ।
১৯৬৬-তে প্রকাশিত হল তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘প্রতিবিম্ব’ । আঙ্গিকগত, কবিতার বিন্যাসগত নানা নিরীক্ষাই আমরা পেলাম যা তৎকালীন বাংলা কবিতার চলন থেকে ভিন্ন ।
যতিচিহ্নহীন এই কবিতাটি স্পেসের ব্যবহারে স্বতন্ত্র ।
স্তম্ভের আকৃতির এই কবিতায় এক দৃশ্যময়তা তৈরি হয় ।পরবর্তী দুটি কবিতায় শব্দসজ্জা বিশেষ রূপ পায় এবং ছবিতার ধারণা আমাদের কাছে স্পষ্ট হতে থাকে ।
শব্দবিন্যাসে এক উড়ন্ত মাছরাঙার ইঙ্গিত ফুটে ওঠে আর ওল্টানো ত্রিভুজাকৃতির এই লেখাটি
‘
শেষের ইলিপ্সিসের ( তিনটি ডট ) ব্যবহার অসম্পূর্ণতা সৃষ্টি করে ।
মানমন্দির’ প্রকাশিত হল ১৯৬৯-এ ।
তাঁর দৃশ্যময় কবিতার কাজগুলি আরও এগিয়ে আসে । ‘মানচিত্র’ কবিতাটি পুনর্লিখিত হয়,চতুর্থ পঙ্ক্তিতে ‘অ ক্ষ রে খা ব রা ব র’ ছাপা হয় বোল্ড টাইপে । শেষ লাইনের ‘জ্যোৎস্নাময়’ শব্দটি বাদ যায়
অন্যান্য লেখাতেও দেখি এই ভিস্যুয়াল প্রয়াসগুলি ।
এবং ‘কবিতা ১’, ‘কবিতা ২’ ও ‘কবিতা ৩” শিরোনামে তিনটি কবিতা ।
কবিতাই তিনটিই বিশিষ্ট। আর বলা যেতে পারে, হাতে লিখে ব্লক করে মুদ্রিত ‘কবিতা-৩’ কবিতাটি গ্র্যাফিক্স কবিতা বা কবিতালেখ ।
পরের বই ‘৪৪৪’ বের হল ১৯৭২-এ ।তাঁর কাজ যেন পূর্ণতা পেল ।
এই কবিতাগুলি দৃষ্টি আকর্ষণ করল পাঠকের ।আর ফুলদানির অবয়বে ‘বিকল্প’ কবিতাটি যার বিষয়ও ফুলদানি, ফুলহীণ ফুলদানির বিকল্প ব্যবহার অবয়ব কবিতার সার্থক উদাহরণ ।
এবং আরও দুটি গ্রাফিক্স কবিতা ।
কবিতাদুটি এক বিমূর্ত চিত্ররূপের মুখোমুখি দাঁড় করায় আমাদের ।
কবির পাঠ্য বিষয় ছিল বাংলা, কিন্তু সমসাময়িক বিশ্বকবিতার সঙ্গে পরিচয় ছিল তাঁর, পরিচয় ছিল তাঁদের ।
“ আপলিন্যের, কোয়াসিমাদো, লোরকা, জাক প্রেভর, পীয়ের রভের্দি আমার প্রিয় কবি” লিখেছেন তিনি । আর তাঁর গবেষণা কবি অমিয় চক্রবর্তীর বিষয়ে, কবিতার শব্দবিন্যাসে নিয়ে যাঁর ভাবনাও অন্যরকম ছিল ।
১৯৭৩-এ ‘পেণ্ডুলাম’, ১৯৮৪-তে ‘লোডশেডীং’,১৯৮৬-তে ‘হাত’, ১৯৮৯-এ ‘শেষ এবং শুরু’, , ২০০১-এ ‘নিজস্ব বলয়’ প্রকাশ পায় ।
এই বইগুলিতে কবিতার অন্তরঙ্গ আঙ্গিকের দিকেই বেশি ঝোঁকেন । কিছু কিছু কবিতাও ছাপ থাকে দৃশয়-উপাদানের । কিন্তু তা আগের বইগুলির মতো প্রবল নয় । কিছু ক্ষেত্রে গণিতের ব্যবহার, রাজনৈতিক ব্যঙ্গ ও জীবনবোধের দীপ্তি আমাদের নজরে আসে ।
এবং ১৯৯৬-এ ‘নির্বাচিত কবিতা’ ও ২০১২-তে ‘কবিতা সংগ্রহ’ প্রকাশিত হয় ।
শুধু কবিতার দৃশ্যগত আবেদনই নয়, ছবিতা, কংক্রিট পোয়েট্রি, অবয়ব কবিতা, গ্রাফিক্স কবিতাই নয় – আবেগের নিয়ন্ত্রণ, যতিচিহ্নের বিলোপ,শব্দ ব্যবহারেরে সংহতি, পরিমিত উচ্চারণ পরেশ মণ্ডলের কবিতাকে বিশিষ্টতা দিয়েছে।
যাঁরা ভবিষ্যতে নিরীক্ষামূলক কবিতা লিখবেন তাঁদের কাছে এক অনন্য দিশা হয়ে উঠবে তাঁর লেখা।
আরও আরও পঠিত হোক পরেশ মণ্ডলের কবিতা, আলোচিত হোক, বিশ্লেষিত হোক ।
কবির আকাক্ষা তো আমরা জানি , এক পঙ্ক্তির কবিতায় তিনি বিবৃত করেছেন
“ সমস্ত জীবন ধরে মৃত্যুদণ্ড প্রার্থনা আমার”
( মুক্তি )
কার মৃত্যুদণ্ড ? কবির নিজের ? না কবিতার চিরায়তের নামে জগদ্দল পাথর বয়ে বেড়ানোর ?
( ‘নির্বাচিত কবিতা পরেশ মণ্ডল, মহাদিগন্ত, প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ১৯৯৬ থেকে উদ্ধৃত কবিতাগুলি নেওয়া হল . । অন্যান্য তথ্যসূত্রঃ পদ্যপত্র, শ্রুতি সংকলন, ২০১৪ )